বালাই নেই শ্রম ঘণ্টার, ‘শরীরে যতক্ষণ শক্তি, ততক্ষণ কাজ

তাপপ্রবাহের দিনগুলোতেও বিরাম নেই তাদের, ভর দুপুরে প্রখর রোদের মধ্যে মাথায় করে বয়ে নিয়ে চলেছেন বোঝা; কর্ণফুলী নদীর তীরে আনুমাঝির ঘাটে দলবেঁধে এক নাগাড়ে কাজ করে চলেছেন তারা।

তাদেরই একজন আমজাদ হোসেন। তপ্ত রোধে মাথায় প্লাস্টিকের চটের বিড়া। মাথার ওপর করে নিয়ে যাচ্ছেন লবণের টুকরি। দেখতে দেখতে তার এ কাজ করার বয়স এক যুগ হয়ে গেছে। ২০১২ সাল থেকে তিনি লবণ ওঠানামার কাজ করছেন।বাড়ি ভোলার চরফ্যাশনে, প্রায় ১২ বছর ধরে আছেন চট্টগ্রামে। এ কাজই করছেন শুরু থেকে।

কাজের এক ফাঁকে, কপাল থেকে ঘাম মুছে আমজাদ বলেন, এক বোট লবণ খালাস করতে অন্তত ২০ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ জন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। প্রতিদিন দুই থেকে তিনটি বোট থেকে লবণ খালাস করলে তারা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পান। তবে শ্রমিকের সংখ্যার ওপর নির্ভর করে তা কমবেশি হয়।

তিনি বলেন, এখানে কেউ স্থায়ী শ্রমিক না। যতদিন শরীরের শক্তিতে পারে ততদিন কাজ করে। না হলে অন্য দিকে চলে যান। আবার কাজ না করলে কোনো রোজগার নাই।শুধু বৈশাখের তপ্ত দুপুরেই নয়, শীত-বর্ষা সব মওসুমেও বিরামহীন কাজ চলে তাদের। কাজে এল মজুরি মেলে, না হলে না।

গাড়িতে তোলার কাজও করতে হয়।”

অপরিশোধিত লবণ পরিশোধনের কাজটি শ্রমিকদের কাছে ‘ধোলাই’ নামে পরিচিত।

শুধু আনুমাঝি ঘাট নয়, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর ১৬টি ঘাটের শ্রমিকদের নিত্যদিনের কাজের চিত্র কমবেশি এমনই। এসব ঘাটে প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের মালামাল, খাদ্যশস্য, লবণ কিংবা পাথর ওঠানামা করা হয় জাহাজ কিংবা ট্রলার থেকে।

তপ্ত রোদে শরীর থেকে ঘাম ঝড়লেও দম ফেলার ফুসরত নেই তাদের। যত দ্রুত একটি ট্রলার বা লাইটারেজ জাহাজ থেকে মালামাল খালাস করতে পারবেন, ততেই দ্রুত কাজ ধরতে পারবেন আরেকটির।

ভোরের আলো ফোটার পর থেকে দুপুরের তপ্ত রোদ, অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করে যান তারা; যাদের নেই কোনো কর্মঘণ্টা, নিয়োগপত্র ও শ্রমিকের আইনগত সুবিধাদি।

এসব শ্রমিকদের ভাষ্য, “শরীরে যতক্ষণ ‘শক্তি’ আছে, ততক্ষণ কাজ করতে হবে। কাজ না করলে কোনো রোজগার নাই। কেউ এক কাপ চাও খাওয়াবে না।”

শ্রম ঘণ্টার হিসাব নিকাশের১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে হে মার্কেটের শ্রমিকরা শ্রমের ন্যায্য মূল্য এবং আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণ করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে। আন্দোলন দমনে সেদিন শ্রমিকদের ওপর গুলি চালানো হয়েছিল। ১০ শ্রমিকের আত্মত্যাগে গড়ে ওঠে বিক্ষোভ। প্রবল জনমতের মুখে যুক্তরাষ্ট্র সরকার শ্রমিকদের আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণ করতে বাধ্য হয়।

১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সের প্যারিসে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে শিকাগোর শ্রমিকদের সংগ্রামী ঐক্যের অর্জনকে স্বীকৃতি দিয়ে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস ঘোষণা করা হয়।

১৮৯০ সাল থেকে সারাবিশ্বে শ্রমিক সংহতির আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে মে মাসের ১ তারিখে ‘মে দিবস’ পালিত হয়।

কিন্তু মে দিবস আসে-যায়, কর্ণফুলী ঘাটে কাজ করা শ্রমিকদের কাজের বিরাম নেই; বেশির ভাগই জানেই না ‘মে দিবস’ কী?

সারাবিশ্বে শ্রমিক সংহতির আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে বুধবার বাংলাদেশেও পালিত হবে মহান ‘মে দিবস’। বালাই নেই তাদের কাছে। তারা জানেও না শ্রম আইন কিংবা আনুষ্ঠানিক শ্রম ঘণ্টার বিষয় আশয়। মে দিবসের কথাও তাদের জানা নেই।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top